করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে মানুষের কাছে জ্বর-সর্দি-কাশি খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে জ্বর হওয়া মানেই মানুষের কাছে এক অজানা আতঙ্ক। তা ছাড়া প্রতিবছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ জনমনে বারবার ভীতি ছড়ায়। এ বছরও ডেঙ্গুর প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাই ডেঙ্গু নিয়েও সচেতন হতে হবে।
জ্বর কেন হয় : সবাই মনে করেন জ্বর একটি রোগ। কিন্তু বাস্তবে জ্বর কোনো রোগ নয়। জ্বর হচ্ছে কোনো একটি রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ। অর্থাৎ কোনো একটি রোগের বহিঃপ্রকাশ বা উপসর্গ হিসেবে মানুষের শরীরে জ্বর বা উচ্চ তাপমাত্রা প্রকাশ পায়। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি হলে আমরা তখন জ্বর বলে থাকি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্বরের কারণের তালিকা বেশ লম্বা।
তবে জ্বরের সাধারণ কারণগুলো হচ্ছে : কমন কোল্ড বা সাধারণ সর্দি-কাশি, বিভিন্ন ধরনের ফ্লু, নাক এবং কানের ইনফেকশন বা প্রদাহ, টনসিলাইটিস বা টনসিলের প্রদাহ, ইউরিন ইনফেকশন বা মূত্রনালির প্রদাহ, বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন : চিকেন পক্স, হুপিং কফ ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ যেমন : টাইফয়েড, সিজনাল ফ্লু, যক্ষ¥া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদির কারণেও জ্বর হয়। এ ছাড়া শরীরের অন্তর্বর্তী নানা ধরনের জটিল রোগ, এমনকি ক্যান্সার জাতীয় রোগের লক্ষণও অনেক সময় জ্বর এর মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। তবে বিগত দুই দশকে মানুষ সাধারণ সর্দি-কাশি কিংবা সিজনাল ফ্লুর পাশাপাশি ডেঙ্গু জ্বর এবং করোনাভাইরাস-জনিত জ্বরে ভোগান্তিতে পড়েছে।
জ্বর হলে বাড়িতে বসে যা করতে পারেন : জ্বর হলে জ্বরের সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গগুলো লক্ষ করুন। বর্তমান সময়ে জ্বরের পাশাপাশি করোনা রোগীদের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে শুকনা কাশি, গলা-ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, সর্দি, স্বাদ বা ঘ্রাণের পরিবর্তন, ডায়রিয়া অথবা অস্বাভাবিক দুর্বলতাজনিত সমস্যা থাকে। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে জ্বর সাধারণত অনেক বেশি হয়, ১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে। সঙ্গে থাকে অসম্ভব গা-ব্যথা, পিঠে ব্যথা, চোখের চারপাশে ব্যথা ও গায়ে লালচে ভাব। তা ছাড়া সিজনাল ফ্লুর লক্ষণ হিসেবে জ্বরের সঙ্গে নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি-কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। বর্তমান সময়ে জ্বর দেখা দিলে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে থাকা ভালো অর্থাৎ আইসোলেশন মানতে হবে। হাঁচি-কাশি থাকলে রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার করতে হবে। অন্যদের রোগীর কক্ষে প্রবেশ করলে অবশ্যই মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।
রোগীকে যথাসম্ভব পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। জ্বরের সময় গোসল করতে মানা নেই। তবে গোসল করার জন্য হালকা কুসুম গরম পানি কিংবা সাধারণ তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া শরীরে জ্বর উঠলে শরীর বারবার ভেজা কাপড় দিয়ে শুকনো করে মুছে দিতে হবে, অর্থাৎ শরীর স্পঞ্জিং করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিষ্কার সুতির পাতলা কাপড় স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে (গরম বা বরফ-ঠাণ্ডা নয়) ভিজিয়ে চিপে নিন। এবার এই ভিজে কাপড় দিয়ে সারা শরীর আলতো চেপে চেপে মুছে নিন। ভেজা কাপড় দিয়ে মোছার পর শুকনো কাপড়ের সাহায্যে পানি মুছে নিন। এ ছাড়া মাথায় পানি দেওয়া কিংবা কপালে জলপট্টি দেওয়া যেতে পারে। ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরতে হবে। ঘরের দরজা-জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত বাতাস যত চলাচল করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
জ্বর হলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, গলা-মুখ শুকিয়ে যায়, এমনকি প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যায়। তাই জ্বর হলে দিনে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করুন। প্রচুর তরল জাতীয় খাবার যেমন লেবুপানি, সরবত, স্যালাইন, স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি খাবার গ্রহণ করতে হবে। তবে ডায়াবেটিস থাকলে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় তরল খাবার পরিহার করবেন। ডেঙ্গু, করোনা অথবা যে কোনো জ্বরের পরবর্তী শারীরিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য বেশি বেশি পানি পান করাটা খুবই জরুরি। জ্বরের রোগীর পথ্য বলে আসলে কিছু নেই, সবই খাওয়া যায়। রোগীর সুষম খাবার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম ও দুধ রাখতে পারেন। তবে তেল-মসলাযুক্ত খাবার হজম করতে কষ্ট হয়, তাই সহজপাচ্য খাবারই ভালো। সবজি মেশানো জাউ-ভাত, স্যুপ ইত্যাদি যথেষ্ট পুষ্টি জোগাবে। বিশেষ করে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফল যেমন : কমলা, মালটা, লেবু, জাম্বুরা, আনারস ইত্যাদি খাওয়া খুবই ভালো। জ্বরের সঙ্গে গলা ব্যথা থাকলে গরম পানিতে লবণ দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা গড়গড়া করলে ব্যথার উপশম হবে। কারও নাক বন্ধ থাকলে কিংবা সাইনোসাইটিসজনিত মাথাব্যথা থাকলে গরম পানির ভাপ নেওয়া যেতে পারে। বছরজুড়ে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করবেন কিংবা মশা প্রতিরোধে অন্যান্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মানুষই ওষুধ গ্রহণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জ্বর ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা দেখা না দিলে অন্তত তিন থেকে সাত দিন প্যারাসিটামল ব্যতীত অন্য কোনো ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত জ্বরের জন্য সাধারণ প্যারাসিটামল (৫০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট) খাওয়া যেতে পারে। তবে যদি ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে উঠে যায় তাহলে ৫০০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল সাপোজিটরি পায়ুপথে গ্রহণ করতে হবে। আর জ্বরের সঙ্গে যদি শরীর ব্যথা কিংবা গলাব্যথা থাকে তবে ব্যথার ওষুধ না গ্রহণ করে, ৬৬৫ বা ১০০০ মিলিগ্রামের প্যারাসিটামল তিন বেলা গ্রহণ করলে শরীর ব্যথা থেকে উপশম পাওয়া যাবে। এ ছাড়া কারও নাক দিয়ে পানি পড়লে কিংবা বারবার হাঁচি দেখা দিলে ফেনাডিন বা অন্যান্য এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এ ওষুধগুলো ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কিনতে পারবেন। তবে এর চেয়ে বেশি ওষুধ প্রয়োজন হলে, বিশেষ করে যে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথার ওষুধ ক্রয়ের পূর্বে অবশ্যই একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। বর্তমান সময়ে জ্বর হলেই সরাসরি হসপিটাল বা চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার আগে বাড়িতে বসে টেলিমেডিসিনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। তা ছাড়া বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা প্রদানকারী বিভিন্ন হটলাইনে ফোন করে পরামর্শ নিতে পারেন।
বিপদ চিহ্নগুলো জানুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন : জ্বর এবং জ্বরসংক্রান্ত বিপদ চিহ্নগুলো অবশ্যই জানতে হবে। কারণ এ ধরনের বিপদ চিহ্নগুলো দেখা গেলে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, প্রয়োজনে হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। কোনো রক্তপাতের লক্ষণ যেমন : শরীরে লাল দাগ বা র্যাস দেখা গেলে, কালো পায়খানা হওয়া, দাঁত ব্রাশ করার সময় দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, কাশির সঙ্গে রক্ত আসা, মহিলাদের মাসিকের রাস্তায় অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া ইত্যাদিসহ শরীরে কোনোরকম রক্তপাতের চিহ্ন দেখা গেলে সরাসরি ডাক্তার কিংবা হসপিটালে যোগাযোগ করুন।
জ্বর চলাকালীন অবস্থায় পালস অক্সিমিটার দিয়ে রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করতে হবে। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫-এর নিচে থাকলে বা তীব্র শ্বাস কষ্ট হলে বা বুকে ব্যথা শুরু হলে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। যদি পানি তীব্র পিপাসা অনুভূত হয় এবং প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় কিংবা বারবার গাড় লাল রঙের প্রস্রাব হয়; যদি মাথা ঘোরায়, তীব্র দুর্বলতা দেখা যায়, মাংসে তীব্র খিঁচুনি অনুভূত হয় কিংবা জ্বরের সঙ্গে যেসব উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়েছে সেগুলোর অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়- তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এক সপ্তাহের বেশি জ্বর থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ দরকার। জ্বর ১০৫ ডিগ্রির ওপর উঠে গেলে, অনেক কাশি, পেটব্যথা, প্রস্রাবে জ্বালা, বেশি বমি হলে, জ্বরের ঘোরে অসংলগ্ন আচরণ করলে বা অচেতনের মতো হলে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি।
যা করবেন না : জ্বর বা জ্বরের সঙ্গে থাকা ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ ছাড়া ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন বা ক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে।
অনেকে জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ কিনে খাওয়া শুরু করে দেন। মনে রাখতে হবে, কিছুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ সেবন করা উচিত না।
জ্বর অনেক কারণেই হতে পারে। জ্বর হতে পারে সাধারণ কিংবা তা হতে পারে কোনো জটিল রোগ অথবা প্রাণঘাতী রোগের উপসর্গের বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং জ্বর হলেই অযথা আতঙ্কের যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি আবার সব জ্বরকে অবহেলা করে আমরা যেন তার জটিলতা না বাড়িয়ে তুলি। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান সময়ে, জ্বর-সর্দি-কাশি হলে প্রথমে আমাদের সবচেয়ে খারাপ কারণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বা ডেঙ্গুজ্বর চিন্তা করে সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে এবং পরীক্ষা করাতে হবে। উপসর্গ জটিল না হলে কিংবা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হলে, জ্বরকে সাধারণ হিসেবে আমলে নিয়ে অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং জ্বর হলে অযথা আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।