রিংওয়ার্ম বা দাদ (Ringworm), চিকিৎসার পরিভাষায় ডার্মাটোফাইটোসিস (Dermatophytosis) নামে পরিচিত।
এই রোগটি মূলত কিছু ফাঙ্গাস-এর আক্রমণে হয়ে থাকে এবং সব থেকে চিন্তায় বিষয় হল রোগটি শরীরের যে কোনও অংশে হতে পারে। তবে নখ, ত্বক এবং স্ক্যাল্প-এ বেশি মাত্রায় হতে দেখা যায়। এছাড়া দাদ প্রথমে একটু থেকে হলেও পরে বাড়তে থাকে। প্রসঙ্গত, রিংওয়ার্ম বা দাদ এক ধরনের বিচ্ছিরি ছোঁয়াচে রোগ। তাই পরিবারের কেউ এমন রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা উচিত। না হলে অল্পদিনেই কিন্তু বাকিদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
দাদ বা রিংওয়ার্ম এর কারণ• ছত্রাকের কারণে দাদ হয়ে থাকে। সাধারনত ভেজা বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা এবং ভালোভাবে আলোবাতাস পায় না এধরনের জায়গায় ছত্রাকের জন্ম হয়।
• অপরিস্কার অপরিচ্ছন্নতা, আটসাট অন্তর্বাস ব্যবহার করলে, অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করলে।
• সংক্রামক ব্যক্তির কাপড়, গামছা, তোয়ালে ব্যাবহার করলে দাদ হতে পারে।
• মাথার চিরুনি দ্বারা ও পায়ের পুরনো মোজা দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।
• সাধারণত অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন শরীর, দীর্ঘ সময় ভেজা থাকে এমন শরীর, ত্বকে ক্ষত আছে এমন শরীরেই ছত্রাকগুলোর স্পোর দ্বারা আক্রান্ত হয়।
• যারা বেশি ঘামেন এবং যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। ঘাম এ রোগের জন্য দায়ী ফাঙ্গাসকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
কোথায় বেশি হয়• মাথার ত্বকে বা চুলের নিচে দেখা যায়।
• দাড়িতে দাদ হয়।
• কুচকিতে ও রানের দু পাশে দাদ হয়।
• পিঠ, পেট, গায়ে দাদ হয়।
• পায়ের তলায় এবং পাতায় দাদ হয়।
• নখে দাদ হয়।
দাদ বা রিংওয়ার্ম এর লক্ষণদাদ হলে প্রথমে আক্রান্ত স্থানে ছোট লাল গোটা হয় এবং সামান্য চুলকায়। পরে আক্রান্ত স্থানে বাদামী বর্ণের আইশ হয় এবং স্থানটি বৃত্তাকারে বড় হতে থাকে। এটি দেখতে অনেকটা চাকার মতো যার কিনারাগুলো সামান্য উঁচু হয়।
যতই দিন যায় চাকার পরিধি বাড়তে থাকে আর কেন্দ্রের দিকে বা ভেতরের দিকে ভালো হয়ে যেতে থাকে। ক্ষত স্থান থেকে খুশকির মত চামড়া ওঠে। কখনো কখনো পানি ভর্তি দানা ও পুঁজ ভর্তি দানা হয়। ক্ষত স্থান অত্যন্ত চুলকায়। মাথায় দাদ হলে আক্রান্ত স্থানের চুল পড়ে যায়। কোমরে বা কুঁচকিতে হলে চামড়া সাদা ও পুরু হয়ে যায়। নখে হলে অস্বচ্ছ ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। দাদ চুলকালে সেখানে জ্বালা হয় ও কষ পড়তে থাকে।
দাদের চিকিৎসাদাদ হয়েছে বুঝতে পারলে যত দ্রুত সম্ভব চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন। এক্ষেত্রে সাধারণত অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ক্রিম ব্যবহার করতে উপদেশ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকগণ। তবে মাথায় বা নখে বেশি ছড়িয়ে পড়লে মুখে খাবার বড়ি দেওয়ারও দরকার পড়ে। বর্তমানে ফাঙ্গাস-এর অনেক কার্যকর ওষুধ বাজারে এসেছে। এগুলো সেবনে শারীরিক প্রতিক্রিয়া খুবই কম। ফাঙ্গাল ওষুধ সেবনের আগে লিভারের কোনো ত্রুটি আছে কিনা তা পরখ করে নিতে হবে। চিকিৎসার আগে তিন-চার মাসের মধ্যে জন্ডিস হওয়ার ইতিহাস থাকলে তা ডাক্তারকে জানাতে হবে। উপযুক্ত চিকিৎসক ছাড়া ওষুধের দোকানদারের পরামর্শে ওষুধ খাবেন না। অনেকেই ফাঙ্গাসকে সহজ ব্যাপার মনে করে ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতার কথায় ওষুধ খেয়ে থাকেন। এটা ঠিক নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফাঙ্গাস সংক্রমণ প্রায় ১০০ ভাগ নিরাময় করা সম্ভব। তবে সেটা আবারো হতে পারে। কারণ ত্বকে ফাঙ্গাস বেড়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হলে সেখানে ফাঙ্গাস বেড়ে উঠতে চেষ্টা করবে। তাই সাধারণ কোন সাবান দিয়ে এটি ধুবেন না। গাছপালা বা হার্বাল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার না করাই ভালো।
দাদ বা রিংওয়ার্ম প্রতিরোধে করণীয়• ক্ষতস্থান শুকনো রাখার চেষ্টা করুন।
• দাদ সংক্রমণ হলে সেই স্থানে যতটা সম্ভব তেল-সাবান না লাগানো ভালো।
• সংক্রমণের জায়গাটা যতটা সম্ভব খোলা রাখতে হবে এবং গেঞ্জি, মোজা, আণ্ডারওয়্যার প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।
• উষ্ণ গরম পানি ও ভালো অ্যান্টিসেপ্টিক সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে, শুকিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করুন।
• এটি ছোঁয়াচে রোগ, তাই পরিবারে একজনের হলে তার কাপড় চোপড় আলাদা করে ফেলুন এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
• দাদ রোগে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা। তাই শিশুদের ব্যাক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে শিক্ষা দিন।
• পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের চিরুণী, তোয়ালে, ব্রাশ আলাদা করুন।
• অন্যের ব্যবহার করা সামগ্রী এড়িয়ে চলুন।
• পোষ্য-প্রাণীর সংস্পর্শে আসার পর হাত ধুয়ে ফেলুন।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশে দাদ এর প্রাদুর্ভাব থাকলেও আমাদের দেশের মতো গরম ও ঘর্মপ্রবণ দেশে বেশি দেখা দেয়। সব বয়সের মানুষই এতে আক্রান্ত হতে পারে এবং একবার আক্রান্ত হলে বাড়বার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। একাধিকবার আক্রান্ত হলে ধৈর্য্যহারা না হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা নিন। মনে রাখবেন, এ রোগের চিকিৎসা খুবই সহজ এবং দ্রুত আরোগ্য সম্ভব, তবে দেরি করলে অনেক সময় জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে।