ফ্রোজেন শোল্ডার কী?শোল্ডার ফ্রোজেন হয়ে যাওয়া এমন একটি রোগ, যেটা শোল্ডার জয়েন্টের ব্যথা এবং জয়েন্ট নড়াচড়া করার সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। প্রাথমিক অবস্থায় ব্যথা অল্প থাকে, ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়ে এবং জয়েন্টের মুভমেন্ট করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক কথায়, কাঁধ নাড়াতে অসহ্য ব্যথা হয়। একে সহজ ভাষায় বলা যায়, হাতের সাথে ঘাড়ের জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া। এটি শোল্ডার জয়েন্টের প্রদাহজনিত রোগ। এ ক্ষেত্রে জয়েন্টের মধ্যকার সাইনোভিয়াল ফ্লুইড নামক এক ধরনের তরল পদার্থ কমে যেতে থাকে। ফলে শোল্ডার জয়েন্ট ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যেতে থাকে। ফ্রোজেন শোল্ডারকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘শোল্ডার অ্যাডহেসিভ ক্যাপসুলাইটিস’ বলা হয়।
কাদের হয়?১। এই রোগটি সাধারণত ৪০-৬০ বছর বয়সে হয়ে থাকে।
২। পুরুষের চেয়ে নারীরা এই রোগে বেশি ভোগেন।
৩। কিছু কিছু রোগ (যেমনঃ স্ট্রোক, সার্জারি) অথবা শোল্ডার জয়েন্টে আঘাত পেলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
কাঁধ নাড়াতে অসহ্য ব্যথা বা ফ্রোজেন শোল্ডার কেন হয়?
এই রোগের প্রধান কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন- হাতের জয়েন্টে আঘাত পেলে, কোনো কারণে জয়েন্ট অনেকদিন না নাড়ানোর কারণে জয়েন্ট শক্ত হয়ে গেলে এ রোগ দেখা দেয়। এছাড়া দেহে কিছু কিছু রোগের অবস্থানের কারণে ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। যেমন- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে শতকরা ১০-২০ জন এই রোগে ভোগেন। অন্যান্য রোগের মধ্যে হৃদরোগ, থাইরয়েড, পারকিনসন এবং হাতের অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর রোগীদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
চিকিৎসকেরা মনে করেন দীর্ঘদিন কাজ না করলে একসময় কাঁধের অস্থিসন্ধি অর্থাৎ জয়েন্টে জড়তার কারণে ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। এছাড়াও কাঁধের অস্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড চাপ পড়লে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কখনোই খুব বেশি ভারী জিনিস তোলা ঠিক নয়। কাঁধ প্রচণ্ড মোচড় খায়, এমনভাবে কাঁধ নাড়িয়ে কোনো কাজ করা উচিত নয়। যদি আগে কখনো কাঁধে চোট পেয়ে থাকেন কিন্তু সঠিক চিকিৎসা করানো হয়নি, এমন হলেও ফ্রোজেন শোল্ডারের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া কাজের চাপ, ঘুমের অভাব, শরীরচর্চা না করা এগুলোর কোনো একটি কারণেও রোগী এই ব্যথায় ভুগতে পারেন।
উপসর্গ- হাতের সাথের ঘাড়ের জয়েন্টে ব্যথা
- জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া
- জয়েন্ট নাড়ানোর ক্ষমতা কমে যাওয়া
- আক্রান্ত পাশে শুতে না পারা
- হাতে দুর্বলতা চলে আসা ইত্যাদি
চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপি ফ্রোজেন শোল্ডার রোগীর কাছে ব্যথা প্রধান সমস্যা মনে হলেও, তার আসল সমস্যা হলো জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া। রোগী যত ব্যথার ভয় করে হাত নাড়ানো বন্ধ রাখবে, তার জয়েন্ট তত বেশি শক্ত হয়ে যাবে। তাই রোগীকে বোঝাতে হবে, ব্যথার ঔষধের চেয়ে হাত নাড়ানোর চিকিৎসা করা বেশি জরুরি। এ ক্ষেত্রে রোগীর ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রেখে হাত নাড়ানোর ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি হলো সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা।
ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর রোগ বর্ণনা, ফিজিক্যাল টেস্ট, ফিজিওথেরাপিউটিক স্পেশাল টেস্ট এবং রেডিওলজিক্যাল টেস্ট এর মাধ্যমে রোগীর জয়েন্টের সমস্যাসমূহ নির্ণয় করে থাকেন। এরপর রোগীর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা বা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করে এবং সেই প্ল্যান অনুযায়ী নিচের পদ্ধতিতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রদান করেন।
ম্যানুয়াল থেরাপি, মোবিলাইজেশন, মুভমেন্ট উইথ মোবিলাইজেশন, থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ ইত্যাদি
ইলেকট্রোথেরাপি বা অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে চিকিৎসা যেমন – আইআরআর, ইউএসটি ইত্যাদি
রোগীর জয়েন্টের সমস্যা দূর করে হাত নাড়ানোর ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ভূমিকা অপরিসীম। ফ্রোজেন শোল্ডার ভালো হতে এক বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। যদি চিকিৎসায় কাজ না হয় তাহলে কখনো কখনো সার্জারি করার প্রয়োজন হয়।
প্রতিরোধ করার উপায় কী?কাঁধে আঘাত বা অপারেশনের পরে হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিংয়ের মাধ্যমে ফ্রোজেন শোল্ডার প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধরতে হবে এবং চিকিৎসকের উপদেশ মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, সঠিক নিয়মে ব্যায়াম করলে সময়ের সাথে সাথে ফ্রোজেন শোল্ডার ভালো হতে থাকে। ফ্রোজেন শোল্ডারের সমস্যা যেন না হয় সেজন্য আগে থেকেই প্রতিরোধ করা জরুরি। কাঁধে কোনো কারণে চোট পেলে অবশ্যই সঠিক চিকিৎসা করাতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম করলেও উপকার মিলবে।
কাঁধ নাড়াতে অসহ্য ব্যথা হলে আমাদের ঘাবড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে ভয় না পেয়ে এ সমস্যা দেখা দিলে অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। নিয়মিত ওষুধ সেবন ও ব্যায়াম করলে সমস্যা অনেকটাই কমে আসে। সেই সাথে পালন করতে হবে হেলদি লাইফস্টাইলও। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
লেখক: সুশান্ত কুমার ঘোষ, ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, ডিআইইউ মেডিকেল সেন্টার