মাংস রাসায়নিকভাবে প্রোটিন, চর্বি, খনিজ পদার্থও বিপুল পরিমাণ পানি নিয়ে গঠিত। প্রাপ্তবয়স্ক কোনো স্তন্যপায়ী জীবের মাংসে সাধারণত ৭৫ শতাংশ পানি, ১৯ শতাংশ প্রোটিন, ২.৫ শতাংশ চর্বি, ১.২ শতাংশ শর্করা এবং ২.৩ শতাংশ এমাইনো অ্যাসিডসহ অন্যান্য নাইট্রোজেনঘটিত পদার্থ থাকে। মাংসে বিদ্যমান প্রধান দুটি পেশী প্রোটিন হচ্ছে- এক্টিন ও মায়োসিন। এছাড়া আছে কোলাজেন এবং ইলাস্টিন নামক প্রোটিন।
মাংসকে মোট দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়-
রেড ও হোয়াইট মিট।
মাংসে মায়োগোবিনের (এক ধরনের প্রোটিন) উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মূলত এই শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। যেসব মাংসে মায়োগোবিন বেশি থাকে, সেসব মাংসের মায়োগোবিন বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে লাল অক্সিহিমোগ্লোবিন তৈরি করে, ফলে মাংসটি লালচে বর্ণ ধারণ করে। এজন্যই এদের রেড মিট বলা হয়। গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি সব স্তন্যপায়ীর মাংসই রেড মিট। মুরগির মাংস হচ্ছে হোয়াইট মিট।
খাসির মাংসের পুষ্টিগুণ:
খাসির মাংসে গরুর মাংসের তুলনায় কিছুটা কড়া ঘ্রাণের কারণে স্বাদে একটু পিছিয়ে থাকলেও পিছিয়ে নেই পুষ্টিগুণে। খাসির মাংসে অন্যান্য মাংসের চেয়ে সাধারণত আমিষ (২১ গ্রাম/১০০ গ্রাম), আয়রন (২.৮ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম) ও সোডিয়ামের পরিমাণ (৮২ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম) বেশি থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাসির মাংসে গরুর মাংসের তুলনায় চর্বি ও কোলেস্টেরল কম থাকে ।
এই মাংসে প্রচুর পরিমানে লৌহ থাকে। তাই আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় লৌহের চাহিদা খাসির মাংস থেকে পেতে পারি।
গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ:
গরুর মাংসের স্বাদ আর ঘ্রাণ দুটোই অতুলনীয়। উপলক্ষ্য যখন কোরবানির ঈদ, তখন গরুর মাংসের আবেদন যেন আরও বেশি বেড়ে যায়। গরুর মাংস খাওয়ার এমন সূবর্ণ সুযোগ ছাড়তে চান না কেউই।
কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও গরুর মাংস আসলেই খুব স্বাস্থ্যকর খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে রয়েছে ১০৩-২১৭ ক্যালরি শক্তি। গরুর মাংসে আমিষের পরিমাণ ১৯-২১ শতাংশ। গরুর মাংস প্রাণীজ আমিষের সমৃদ্ধ উৎস। এতে ৮টি প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিডের প্রত্যেকটিই থাকে, যা দেহের বৃদ্ধি এবং ক্ষয়পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন- গরুর বয়স, লিঙ্গ, কেমন খাবার খাওয়ানো হয়েছে
প্রভৃতি।
মাংসে চর্বির উপস্থিতি মাংসের ঘ্রাণ আনার সাথে সাথে ক্যালরির পরিমাণও বাড়ায়। চর্বি কম থাকলে সেই মাংসকে বলা হয় রেড মিট। সাধারণ মাংসে (হাড়ছাড়া ও চর্বিসহ) চর্বি যেখানে থাকে প্রায় ১৪-১৫ গ্রাম/১০০ গ্রাম, সেখানে এই লিন মিটে (হাড় ও চর্বিছাড়া) চর্বি থাকে মাত্র প্রায় ২.৩ গ্রাম/১০০ গ্রাম। গরুর মাংসে অন্যান্য মাংসের তুলনায় পটাশিয়াম, ভিটামিন বি১ ও ভিটামিন বি২ পরিমানে বেশী থাকে। গরুর কলিজায় ভিটামিন-এ অধিক পরিমাণে (৪৯৬৮ মাইক্রো গ্রাম/১০০ গ্রাম) থাকে ।
গরুর মাংসে সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ প্রায় সমান সমান থাকে। এতে উপস্থিত ফ্যাটি এসিডের মধ্যে রয়েছে স্টিয়ারিক এসিড, ওলিক এসিড ও পামিটিক এসিড। গরুর মাংসে ট্রান্স ফ্যাটও রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কনজুগেটেড লিনোলেয়িক এসিড। অতিরিক্ত চর্বি খাওয়া সবসময়ই খারাপ। এতে বিপাকীয় বিপর্যয়ে পড়তে হতে পারে আপনাকে।
গরুর মাংস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, এমন ধারণার সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে,
রেড মিট হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, তবে সেটা প্রক্রিয়াজাতকৃত হলে। তাজা মাংস খেলে এই ঝুঁকি একটু হলেও কম থাকে। তবে চর্বিযুক্ত গরুর মাংস রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ায়, আর কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে বিপদ ঘটতেই পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, গরুর মাংস খেতে পারেন, তবে চর্বি থেকে দূরে থাকুন।
ভেড়ার মাংসের পুষ্টিগুণ:
ভেড়ার মাংস লাল মাংস হিসেবে বিবেচিত হয় এবং প্রোটিনের একটি সুস্থ ও নির্ভরযোগ্য উৎস বলে মনে করা হয়। চর্বি খুব সামান্য পরিমানে আছে। স্বাদের প্রসঙ্গ আসলে বলতে হয় ভেড়ার মাংস হালকা স্বাদযুক্ত হয়। ভেড়ার মাংসের বারবিকিউ বা বেকড বর্তমানে সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। এই মাংসের অন্যান্য দুটি প্রজাতি আছে হজ্ঞেট এবং মাটন। হজ্ঞেট সাধারণত ১ থেকে ২ বছর বয়সের ভেড়া থেকে আসে। আর মাটন আসে প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়া থেকে।
উচ্চমাত্রার ক্যালরিসমৃদ্ধ উন্নতমানের আমিষ জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম ভেড়ার মাংসে থাকে ১৯৬ ক্যালরি শক্তি। রান্না করা পাতলা টুকরোর ভেড়ার মাংসে ১৯ শতাংশ আমিষ থাকতে পারে। ভেড়ার মাংসে চর্বির পরিমাণ বেশি (১৩.৬ গ্রাম/১০০ গ্রাম)। এর কলিজায় জিঙ্ক এর পরিমাণ বেশি ।
মহিষের মাংসের পুষ্টিগুণ:
মহিষের মাংসের দাম আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে গরুর মাংসের চেয়ে কম হওয়ায় ভোক্তাদের অনেকের মধ্যে মহিষের মাংস সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। যদিও গরুর চেয়ে মহিষের মাংস ও দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। হয়তো এ কারণে চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় মহিষের মাংস বেশ জনপ্রিয়।
পরিমিত পরিমাণের ক্যালরি ও কোলেস্টেরল এবং উচ্চমাত্রার ভিটামিন ও খনিজ লবণ নিয়ে গঠিত মহিষের মাংস সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর একটি খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মহিষের মাংসে মাত্র ৯০ ক্যালরি শক্তি এবং প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম থাকে। গরুর মাংস থেকে মহিষের মাংসে চর্বিও কোলেস্টেরলের পরিমাণ যথেষ্ট কম হওয়ায় নির্দ্বিধায় আপনি মহিষের মাংস খেতে পারেন।
হাঁসের মাংসের পুষ্টিগুণ:
সুস্বাদু মজাদার খাবারের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় হাঁসের মাংস শীর্ষস্থান দখল করে আছে বলার অপেক্ষা রাখেনা। হাঁসের মাংস খেতে খুব সুস্বাদু হয়।
শীতকালে হাঁসের মাংস খেতে সুস্বাদু হয়। এ সময় সবাই কমবেশি হাঁসের মাংস খায়। নানাভাবেই হাঁসের মাংস রান্না করা যায়। হাঁসের মাংস প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। হাঁসের মাংসে অধিক পরিমাণে ফোলেট বিদ্যমান। এতে নিয়াসিন, ফসফরাস, রিবোফ্লোবিন, আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি৬ এবং থায়ামিন আছে। এ ছাড়া অল্প পরিমাণে আছে ভিটামিন বি১২ এবং ম্যাগনেশিয়াম। চামড়াসহ হাঁসের মাংসে অধিক মাত্রায় ফ্যাট এবং কোলেস্টেরলও আছে।
মুরগির মাংসের পুষ্টিগুণ :
মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। যা পেশীকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখে। কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন হওয়ায় এটি ওজন কমানোর ভালো উৎস। তবে বুকের মাংস থেকে রানের মাংসে প্রায় ৪ গুণ বেশি চর্বিথাকে। মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, নিয়াসিন, ম্যাগনেশিয়াম ও সোডিয়াম থাকে। মুরগীর কলিজায় গরুর ও ভেড়ার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে ফোলেট, ভিটামিন সি, আয়রণ ও ক্যালসিয়াম থাকে।
প্রতি ১০০ গ্রাম ব্রয়লার মুরগীতে . ক্যালরি রয়েছে ১০২ গ্রাম, ফ্যাট ২.২ গ্রাম,কোলেস্টেরল ৬২ গ্রাম, সোডিয়াম ৩৮ গ্রাম, পটাশিয়াম ২৮৪ গ্রাম, প্রোটিন ৬২ গ্রাম, ভিটামিন-এ ১ গ্রাম, আয়রণ ১.৮ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১ মি.গ্রা, ফসফরাস ১৪৭ মি.গ্রা, জিংক ১.৩ মি.গ্রা ইত্যাদি।
প্রতি ১০০ গ্রাম দেশী মুরগীতে রয়েছে ক্যালরি ১৮৫ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ০.৪ গ্রাম, ফ্যাট ৩২.২ গ্রাম, প্রোটিন ৩১ গ্রাম,ভিটামিন-এ ২১ মি.গ্রা, ভিটামিন – কে, ই ০.৩ মি.গ্রা, কোলিন ৮৫.৩ গ্রা. নায়াসিন-১৩.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৫ গ্রাম, সিলিনিয়াম -২৭.৬ মাইএোগ্রাম,কোলেস্টেরল-৮৫ গ্রাম।
কবুতরের মাংসের পুষ্টিগুণ :
কবুতরের মাংস খেতে খুব সুস্বাদু। তবে এটি ভুনা করলে এর স্বাদ বেশি পাওয়া যায়। এটি রোগীর পথ্য হিসাবে কাজ করে। এতে প্রচুর পরিমানে আয়রন থাকায় রক্ত বর্ধনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কবুতরের মাংস শুধুমাত্র পুষ্টিকর নয় এটি সু স্বাস্থ্যকর ও অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা এটি আমাদের যকৃত, কিডনি, স্মৃতিশক্তি উন্নতি করে, রক্তচাপ হ্রাস করে, রক্তে শর্করাকে সামঞ্জস্য করে, সৌন্দর্যকে সুন্দর করে তোলে। মসৃণ কোমল ত্বক দীর্ঘায়ুতে সহায়তা করে।
প্রচলিত আছে একটি কবুতর এর মাংসে থাকা পুষ্টি গুন ৯ টি মুরগির পুষ্টির সমান। এক গবেষণায় দেখা যায় অন্যান্য মাংসের তুলনায় কবুতরের মাংসে প্রায় ২-২৪ শতাংশ বেশি প্রোটিন রয়েছে। এবং এতে ফ্যাটের পরিমান খুবই সামান্য প্রায় ১ শতাংশ। এছাড়াও এই মাংসে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, বি, ই ও ভিটামিন ডি এবং আয়রন, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম ও কপার রয়েছে।
কোয়েল পাখির মাংসের পুষ্টিগুণ:
কোয়েল মাংসে ভিটামিন এ,ভিটামিন বি ছাড়াও ভিটামিন ই রয়েছে ।ভিটামিন ই (Vitamin E ) ত্বককে সুস্থ রাখে ।
কোয়েল মাংসে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম রয়েছে । এ দু’ধরনের উপাদান হাড়কে মজবুত রাখতে সহায়তা করে । কোয়েল মাংস হাড়ের সমস্যা বিশেষ করে অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis) হতে কিছুটা হলেও রক্ষা করে ।
এছাড়াও দেহের গঠন,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি,হৃদপিন্ডকে সুস্থ রাখা, ব্রেইন কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা,রক্তের হিমোগ্লোবিনের বৃদ্ধি করা সহ ডাইজেস্টিভ সিস্টেমকে সতেজ রাখা ।
কোয়েল মাংসের অনেক উপকারী দিক থাকলেও । অতিরিক্ত কোয়েল মাংস ভক্ষণে খারাপ দিকও রয়েছে । অতিরিক্ত কোয়েল মাংস ভক্ষণে কিডনিতে পাথর ( Kidney stones) হওয়ার ঝুঁকি থাকে ।
হাঁসের মাংসের মধ্যে ফ্যাটি অ্যাসিড যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। তাই হাঁসের মাংস নিয়মিত খেলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের তাপমাত্রা উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে এই ফ্যাটি অ্যাসিড। এ ছাড়া হাঁসের মাংসে উচ্চখনিজ পদার্থ থাকায় গলাব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে যাদের উচ্চরক্ত চাপের সমস্যা আছে, তাদের হাঁসের মাংস স্বল্প পরিমাণে খাবেন।কারণ এতে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।