Author Topic: পেটে ব্যথা কারণ, চিকিৎসা, প্রতিকার ও পরামর্শ। হঠাৎ পেট ব্যাথা হলে করনীয়  (Read 2417 times)

0 Members and 2 Guests are viewing this topic.

Dr. Sushanta Kumar Ghose

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 363
  • Gender: Male
    • View Profile
বেশিরভাগ সময়েই পেট ব্যথা কোন গুরুতর রোগের কারণে হয় না। কয়েকদিনের মাঝেই সেরে যায়। আমাদের যে বিভিন্ন রকমের পেট ব্যথা হয় এবং সেগুলোর সম্ভাব্য কারণ এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হয়েছে। তবে নিজেই নিজের রোগ নির্ণয় করার চেষ্টা করবেন না। ব্যথা নিয়ে চিন্তিত হলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের শরনাপন্ন হবেন। আর যে ১১টি সময়ে আপনাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে, সেগুলো অবশ্যই জেনে নিবেন।

পেট ব্যথা কেন হয়?
পেট ব্যথার ধরন   ------------------------------------------------------------------------সম্ভাব্য কারণ
পেট ফাঁপা বোধ করা ও অতিরিক্ত বায়ু ত্যাগ করা----------------------------------------------আটকে থাকা বায়ু
খাওয়ার পর পেট ভরা ভরা বা ফেঁপে আছে এমন মনে হওয়া,
 বুক জ্বালাপোড়া করা এবং বমি বমি লাগা -----------------------------------------------------বদহজম
পায়খানা না হওয়া --------------------------------------------------------------              কোষ্ঠকাঠিন্য
পানির মত তরল পায়খানা হওয়া, বমি বমি বোধ করা, বমি হওয়া -------------------------------    ডায়রিয়া অথবা ফুড পয়জনিং



আর কী কী কারণে পেট ব্যথা হয়?
পেট ব্যথার ধরন    -------------------------------------------------------------- ------------সম্ভাব্য কারণ
১. পেটের নীচের অংশে ডান দিকে হঠাৎ ব্যথা শুরু হওয়া-----------------------------------------------অ্যাপেন্ডিসাইটিস
পেট কামড়ানো, পেট ফেঁপে ওঠা, পাতলা পায়খানা, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া--------------------------------- ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম বা আইবিএস
পেট বা পিঠের একপাশে তীব্র ব্যথা হওয়া যা কুঁচকি পর্যন্ত নেমে আসে,
বমি বমি ভাব হওয়া, প্রস্রাব করার সময় ব্যথা অনুভব করা---------------------------------------------   কিডনিতে পাথর
পেটের মাঝামাঝি অংশে বা পাঁজরের ডান পাশের ঠিক নীচে কয়েক ঘন্টা ধরে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া-----------  পিত্তথলিতে পাথর
পেটের মাঝামাঝি অংশে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হওয়া, বমি ভাব বা বমি হওয়া, গায়ে জ্বর আসা------------------প্যানক্রিয়াটাইটিস
মাসিকের সময় পেটে ব্যথা হওয়া বা কামড়ানো--------------------------------------------------------মাসিকের ব্যথা



পেট ব্যথা হলে কখন ডাক্তারের সহায়তা নিবেন?
বারবার পেট ব্যথা অথবা পেট ফেঁপে ওঠার সমস্যা হতে থাকে
পেট ব্যথা বা পেট ফাঁপা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে এবং সহজে সারতে চায় না
পেট ব্যথার পাশাপাশি খাবার গিলতে সমস্যা হয়, খাবার গলায় আটকে যায়
কোন কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন কমতে থাকে
ঘন ঘন বমি হয়
পেটে চাকার মত মনে হয়
আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতায় ভোগেন
হঠাৎ করেই আপনার প্রস্রাব স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশী বার হয়
প্রস্রাব করার সময় আপনি ব্যথা অনুভব করেন
পায়খানার রাস্তা অথবা যোনিপথ তথা মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্ত যায়, অথবা মাসিকের রাস্তা দিয়ে এমন স্রাব যায় যা অস্বাভাবিক
ডায়রিয়া কিছুদিনের মধ্যে সেরে না ওঠে

ডাক্তারকে যেসব বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন, সেগুলো হল:

পেট ব্যথা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ
কী করলে ব্যথা কমতে পারে
কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদহজমের জন্য কোন ওষুধ খাওয়া যেতে পারে
কেমন পেট ব্যথা হলে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে যাবেন
ব্যথা খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যায় বা গুরুতর রূপ ধারন করে
একেবারে হঠাৎ করেই পেট ব্যথা শুরু হয় বা ব্যথা প্রচণ্ড তীব্র হয়
পেটে স্পর্শ করলে সেই জায়গা ব্যথা করে
বমির সাথে রক্ত যায় বা বমির রং কফিদানার মত কালচে বাদামী হয়
পায়খানার সাথে রক্ত যায় বা পায়খানা কালো, আঠালো এবং প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত হয়
প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়
পায়খানা বা বায়ু ত্যাগ বন্ধ হয়ে যায়
শ্বাস নিতে কষ্ট হয়
বুকে ব্যথা হয়
ডায়বেটিস আছে এমন কারো বমি হয়
রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়
এসব লক্ষণ মারাত্মক কোন রোগের কারণে হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই দেরি না করে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে যাবেন

পেটে ব্যথা হলে কী করবেন?
হঠাৎ পেটে ব্যথা। বুঝতে পারছেন না এটি গ্যাস্ট্রিক নাকি অন্য কিছু। কী ওষুধ খাবেন, কার কাছে যাবেন, তা-ও বুঝতে পারছেন না। পেটে ব্যথার সঠিক স্থান, ধরন-ধারণ, আনুষঙ্গিক উপসর্গ ইত্যাদি মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো আছেই। প্রথমেই খেয়াল করতে হবে ওপর পেটে ব্যথা হচ্ছে, না তলপেটে। ওপরে হলে ব্যথা এক আঙুল দিয়ে নির্দেশ করলে সেটা কোন জায়গায় ওপর ডান, নাকি ওপর বাম? ব্যথাটা কোন দিকে ছড়াচ্ছে? কামড়ে ধরে আছে নাকি চিনচিন করছে, না জ্বালা করছে? সঙ্গে বমি, অরুচি, পায়খানার সমস্যা ইত্যাদি আছে কি না। কোনো কিছু খেলে বাড়ে নাকি খালি পেটে বাড়ে?

কেমন হতে পারে পেটে ব্যথার ধরন?
* পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা সাধারণত পেটের ওপর দিকে মাঝখানে শুরু হয়। এটি খালি পেটে বাড়ে, কখনো চিনচিনে, কখনো জ্বালাপোড়ার মতো মনে হয়। এর সঙ্গে বমিভাব, টক ঢেকুর, পেট ফাঁপা ইত্যাদি থাকতে পারে। অ্যান্টাসিড বা অন্য গ্যাস্ট্রিকের ওষুধে বেশ উপশম মেলে।
* একই জায়গায় বা একটু বাঁ দিকে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। কিন্তু এই ব্যথা প্রচণ্ড তীব্র, পেছন দিকেও অনুভূত হয়। রোগী ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। সামনে ঝুঁকে থাকলে আরাম মেলে। সঙ্গে বমি থাকতে পারে।
* ওপরের পেটের ডান দিকে ব্যথা হতে পারে পিত্তথলিতে প্রদাহ বা পাথর থাকলে। এই ব্যথাও ডান দিকে পেছন পর্যন্ত ছড়ায়, সঙ্গে বমি হতে পারে। বিশেষ করে চর্বিযুক্ত খাবার খেলে এটি বাড়ে। যকৃতের প্রদাহেও একই জায়গায় ব্যথা হয়। চিনচিন করে ব্যথা, সঙ্গে জ্বর, জন্ডিস, অরুচি ইত্যাদি হেপাটাইটিস বা যকৃতে প্রদাহ নির্দেশ করে। যকৃতে ফোঁড়া হলে এই ব্যথা তীব্র হয়, সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর।
* পেটের ওপরের দিকে ডান অথবা বাঁ কিডনিতে পাথর, প্রদাহ বা সংক্রমণ হলে সেই পাশে ও পেছনে ব্যথা হয়। এই ব্যথা ক্রমেই নিচে নেমে তলপেটেও ছড়ায়। কিডনির ব্যথা প্রচণ্ড তীব্র হয়, একটু পরপর ছাড়ে, আবার আসে। সঙ্গে বমি, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর থাকতে পারে।
* নাভির মাঝখান থেকে ব্যথা যদি ক্রমেই তলপেটের ডান দিকে ছড়িয়ে যায়, সেখানে হাত দিলেই ব্যথা হয়, ধীরে ধীরে তীব্রতা বাড়তে থাকে, তাহলে তা অ্যাপেন্ডিসাইটিস কি না, ভাবতে হবে।
* তলপেটে ব্যথার সঙ্গে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া ও জ্বর প্রস্রাবের সংক্রমণ নির্দেশ করে। মেয়েদের জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের নানা সমস্যায় ব্যথা হতে পারে।
* সাধারণ আমাশয়, ফুড পয়জনিং ও বদহজম থেকে ব্যথা পেটজুড়ে থাকে। বমি বমি ভাব, পেটে শব্দ, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হয়। আবার কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেও পেটে ব্যথা হয়।
* দীর্ঘদিনের পেটের ব্যথার সঙ্গে ওজন হ্রাস, রক্তশূন্যতা, দুর্বলতা ইত্যাদি সতর্কসংকেত। অন্ত্রে ক্যানসার বা টিবিরও লক্ষণ এই পেটে ব্যথা। তাই পেটের ব্যথাকে ছোট করে দেখবেন না।

পেটে ব্যথা হলে কী করণীয়?
যদি গ্যাসের কারণে পেটে ব্যথা মনে করেন এবং এর সঙ্গে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণগুলো প্রকাশ না হয়, তাহলে গ্যাসের ওষুধ দিতে পারেন। সিরাপ দিতে পারেন। ব্যথা কমানোর জন্য অনেক ওষুধ আছে সেগুলো দিতে পারেন। তবে নিশ্চিত হতে হবে আপনার ঝুঁকির বিষয়গুলো হয়নি। হঠাৎ করে সমস্যা হয়েছে কি না, বমি হয়েছে কি না, জ্বর আছে ক না—এই বিষয়গুলো সঙ্গে না থাকলে খুব চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা করলেই হয়।

কমবেশি সবারই খুব পরিচিত ও সাধারণ সমস্যা হচ্ছে পেটের ব্যথা। এটি হওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে ভালো খবর এই যে, এসব কারণে বেশিরভাগই গুরুতর না এবং এগুলোর লক্ষণও দ্রুত চলে যায়।

কিন্তু তার পরও পেটে ব্যথা হওয়াটা বিরক্তের বিষয় এবং ছোট হলেও এটি একটি সমস্যা। তাই এটি অবহেলা করা যাবে না। বরং বেছে নিতে হবে সমাধানের উপায়।

আমরা সবাই জানি যে, ব্যথানাশক বিভিন্ন ওষুধের অনেক ক্ষতিকারক দিক আছে। তাই খুব বেশি জরুরি না হলে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। এক্ষেত্রে আপনার পেটের ব্যথা নিরাময়ে বেছে নিতে পারেন প্রকৃতিক সমাধাণ। তা হলে তা আপনার শরীরের কোনো ক্ষতি না করে সহজেই দূর করতে পারবেন পেটে ব্যথার সমস্যা।

এ জন্য আজ জেনে নিন পেটব্যথা কমানোর কিছু প্রাকৃতিক সমাধান—

১. আদা বা আদা চা
প্রচীনকাল থেকেই ব্যথা কমাতে এবং বমি ভাব দূর করতে আদাকে প্রকৃতিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি ও প্রদাহ বিরোধী গুণ থাকায় এটি ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। তাই প্রকৃতিকভাবে পেটের ব্যথা কমাতে আদা কুঁচি করে অথবা চিবিয়ে খেতে পারেন।

২. কলা ও আপেল
কলা ও আপেলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। আর এ কারণে এগুলো পেটের ব্যথা কমাতে সহায়তা করতে পারে। এ ছাড়া এটি বমি ভাব ও ডায়রিয়াতেও উপকারী হিসেবে কাজ করে।

৩. ভাত
ভাবে কোনো মশলা বা লবন থাকে না। তাই এটি পেটের ব্যথা থাকলে তা নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে। পেটে ব্যথা হলে ভারি ও বেশি মশলা জাতীয় খাবার পরিহার করে একটু নরম করে ভাত খেতে পারেন। আর চেষ্টা করবেন এর সঙ্গে একটু হালকা ও পাতলা জাতীয় কিছু খেতে।

৪. টোস্ট
টোস্ট বিস্কুট বা ওভারকুক করা রুটি পেট ব্যথা কমাতে সহায়তা করতে পারে। এতে তেমন কোনো তেল থাকে না। আর এ ছাড়া একটু পোড়া রুটি বা টোস্ট বমি ভাব কমাতেও সহায়তা করে।

৫. পুদিনা পাতা
পেটের ব্যথা ও বমি ভাব কমাতে এবং পেট খারাপের জন্য অনেক সহায়ক একটি প্রাকৃতিক সমাধাণ হচ্ছে পুদিনা পাতা। এটির প্রকৃতিক ব্যথানাশক বৈশিষ্ট রয়েছে। তাই পেট ব্যথা কমানোর প্রাকৃতিক সমাধাণ হিসেবে চায়ের সঙ্গে বা চিবিয়ে পুদিনা পাতা খেতে পারেন।

৬. অ্যাপেল সিডার ভিনেগার
অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে অ্যাসিড স্টার্চ থাকায় তা হজম করতে সাহায্য করে অন্ত্রের ব্যকটেরিয়াকে সুস্থ রাখে। আর এ কারণে এটি পেটের ব্যথা কমাতে সহায়তা করতে পারে।
এর জন্য এক কাপ পানিতে এক চামুচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার ও এক চামুচ মধু মিশিয়ে পান করলে উপকার পাবেন।

৭. হিটিং প্যাড
পেটের ব্যথা কমাতে পেটে হালকা গরম করার মতো হিটিং প্যাড ব্যবহার করতে পারেন। এটি যে কোনো ধররনের ক্রাম্পিং বা ব্যথা নিরাময়ে অনেক উপকারী ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি এটি বমিভাব কমাতেও সহায়তা করে।

এর জন্য আপনি গরম পানির ব্যাগ বা বোতলে হালকা গরম পানি নিয়ে পেটে ধরে রাখলেই অনেকটা স্বস্তি পাবেন। তবে এট খুব বেশি সময় ও অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করবেন না। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে তা ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।




লেখক: সুশান্ত কুমার ঘোষ, ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, ডিআইইউ মেডিকেল সেন্টার