Author Topic: ফুট ড্রপের কারণ এবং এর প্রতিকার  (Read 1669 times)

0 Members and 1 Guest are viewing this topic.

Dr. Sushanta Kumar Ghose

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 363
  • Gender: Male
    • View Profile


আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং চলাফেরার জন্য পা এবং পায়ের পাতা শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পা এবং পায়ের পাতা আমাদের সমস্ত বর বহন করে ও শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। পায়ের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে ফুট ড্রপ অন্যতম।ফুড ড্রপের ফলে দৈনন্দিন চলাফেরা ব্যাহত হয় এবং অতিমাত্রায় ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়। পায়ের সামনের অংশ উপরে উঠানোর সাথে জড়িত মাংসপেশী দুর্বলতা বা পক্ষঘাতের কারণে ফুট ড্রপ হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৯ জন ব্যক্তির ফুড ড্রপ আছে যার মধ্যে ৯০% মানুষই এক পায়ে ফুট ড্রপ জনিত সমস্যায় ভুগছেন।ফুট ড্রপ সাধারণত স্থায়ী অথবা অস্থায়ী উভয় প্রকার হতে পারে।

ফুট ড্রপ কি?
সাধারণত ফুট ড্রপ কোন রোগ নয়, এটি স্নায়বিক, শারীরবৃত্তীয় বা পেশী সংক্রান্ত সমস্যার লক্ষণ।ফুট ড্রপ হচ্ছে একটি চলাফেরার অস্বাভাবিকতা যখন পায়ের পাতা হাঁটাচলার সময় মাটির সাথে ছেচরে যায় অথবা পায়ের পাতা উপরের দিকে উঠাতে অক্ষমতাই ফুট ড্রপ অর্থাৎ পায়ের পাতা উপরে উঠানোর মাংসপেশি (ডোরসি ফ্লেক্সর গ্রুপের মার্সেল) দুর্বলতার ফলে পায়ের পাতা উঠানোর অক্ষমতা বা হাঁটার সময় পায়ের সামনের অংশ মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়া কে ফুট ড্রপ বলে।


যে সকল কারণে হতে পারে ফুট ড্রপ:
নার্ভে আঘাত: কমন পেরোনিয়াল নার্ভ আমাদের পায়ের পাতা  উপরে টানার মাংসপেশীগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। ফুট ড্রপের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এই পেরোনিয়াল নার্ভে কম্প্রেশন বা সংকোচন জনিত আঘাত। এই পেরোনিয়াল নার্ভ ঊরুসন্ধি ও হাঁটুর প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফুট ড্রপ হতে পারে। তাছাড়া মেরুদন্ড থেকে আসা পায়ের নার্ভে কোন আঘাত বা সংকোচনের ফলে ফুট ড্রপ হতে পারে একে “পিঞ্চড নার্ভ” বলে।যেমন-সাইএটিক নার্ভ কম্প্রেশন, লাম্বার রেডিকোলোপেথি, ডিকস হার্নয়েশন, স্পন্ডাইলিটিস, স্যাক্রো ইলিয়াক লিগামেন্ট এবং লাম্বোসেক্রাল ব্যান্ড কম্প্রেশন ইত্যাদি ।

এছাড়াও হাটু এবং পায়ে বিভিন্ন ধরনের আঘাত যেমন- টিবিয়ার মাথা ভেঙে যাওয়া, পেটালা ডিস লোকেশন, আঙ্কেল ইনভার্শন ইনজুরি, রুট ট্রাফিক এক্সিডেন্ট ইত্যাদি কারণে ফুট ড্রপ হয়ে থাকে।

মাংসপেশী ও স্নায়ুর ব্যাধি: বংশগত বিভিন্ন ধরনের মাসকুলার ডিসট্রফি, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, পোলিও মাইলেটিজ, ক্রনিক কম্পার্টমেন্ট সিন্ড্রোম জিবিএস ও চারকেটি-মেরি-টুথ রোগের ফলে ফুট ড্রপ হয়ে থাকে।

মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের ব্যাধি: যে ব্যাধিগুলি মেরুদন্ড বা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে – যেমন অ্যামিওট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস (ALS), একাধিক স্ক্লেরোসিস বা স্ট্রোক, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, সেরিব্রাল পলসি, বংশগত স্প্যাস্টিক প্যারাপ্লেজিয়া মায়োট্রফিক প্যারাপ্লিজিয়া, মেরুদণ্ডে আঘাত, এবং ব্রেন এবং স্পাইনাল কর্ডে টিউমার এর ফলে ফুট ড্রপ হতে পারে।

ফুট ড্রপের লক্ষণ সমূহ:

ফুট ড্রপে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাঁটার সময় পায়ের আঙ্গুল গুলি মাটির সাথে টেনে নেওয়া এড়াতে তাদের পা স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচুতে তোলে এবং হাঁটু বাঁকিয়ে রাখে। পা মাটিতে ফেলার সময় পায়ের পাতা নিচের অংশ দ্বারা মাটিতে থাপ্পড় দেওয়ার মতো শব্দ হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে হাই স্টেপেজ গেইট বলে।

তাছাড়াও পায়ের গোড়ালি শক্ত হয়ে যাওয়া, ট্যান্ডন একেলিস সংকুচিত হয়ে যাওয়া, পায়ের গোড়ালি, পায়ের পাতায় ব্যথা অনুভব করা এবং হাইপার এক্সটেন্ট নি অর্থাৎ হাটু পিছনের দিকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেঁকে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ গুলি ফুট ড্রপের সাথে লক্ষ্য করা যায়।




যে সকল ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফুড ড্রপ হতে পারে:

- অভ্যাসগতভাবে কারো কারো পা ক্রস করে হাঁটাচলা করে থাকেন এক্ষেত্রে পায়ের উপরের দিকে পারোনিয়াম নার্ভ সংকুচিত হয়ে ফুট ড্রপের ঝুঁকি বাড়ায়।

- দীর্ঘক্ষণ হাঁটু গেড়ে  বসে থাকা অথবা এ অবস্থায় কাজ করা যেমন-কৃষিকাজে জমির আগাছা পরিষ্কার ও বিভিন্ন শাকসবজি উত্তোলন, মেঝেতে টালি বিছানো এ ধরনের কাজে ফুট ড্রপের ঝুঁকি বেশি থাকে।

- পায়ের হাড় ভাঙ্গার চিকিৎসা হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদী প্লাস্টার অফ প্যারিসের ব্যবহার এবং টাইট ফিট প্লাস্টার ব্যবহারের ফলে ফুট ড্রপের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

- কোমরে পূর্ববর্তী আর্থ্রাইটিস ও রেডিকোনপেথির উপসর্গগুলি থাকলে এমত অবস্থায় ভারি কোন জিনিস মাথায় বহন অথবা পড়ে যাওয়ার ফলে ফুট ড্রপের ঝুঁকি বহু অংশে বৃদ্ধি পায়।

- কিছু কিছু খেলাধুলা যেমন- ফুটবল, ভলিবল ,ব্যাডমিন্টন, দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্প এবং হকের মত খেলায় ফুট ড্রপের ঝুঁকি বেশি থাকে।


ফুট ড্রপ নির্ণয়ের যে সকল টেস্টর প্রয়োজন:

শারীরিক পরীক্ষা: একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ম্যানুয়াল মাসেল টেস্টিং এর মাধ্যমে পায়ের মাংসপেশি শক্তি পরীক্ষা এবং পরিমাপ করে থাকেন। তাছাড়া অনেক ধরনের নিউরোমাসকুলার পরীক্ষার মাধ্যমে পায়ের অনুভূতি, রিফ্লেক্স, তাপমাত্রা এবং জয়েন্ট ডিফরমিটি পরিমাণ নির্ণয় করে থাকেন।

এক্সরে: এক্সরের মাধ্যমে পায়ের হাঁড় ও জয়েন্টের অস্বাভাবিক অবস্থান ও ফুট ড্রপের সাথে হাঁড় ও জয়েন্টের সম্পৃক্ততা নির্ণয় করা যায়।

আল্ট্রা সাউন্ড: আল্ট্রাসাউন্ড টেকনোলজি শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে শরীরে ভেতরের অঙ্গ পতঙ্গের সুক্ষ ছবি তৈরি করে থাকে যার ফলে কোন সিস্ট অথবা টিউমার নার্ভের উপর চাপ প্রয়োগ করলে অথবা কোন নার্ভে প্রদাহ থাকলে তা নির্ধারণ করা সহজ হয়।

সিটি স্ক্যান: সিটি স্ক্যান সাধারণত এক্স এর মতই বিভিন্ন কোন থেকে শরীরের ছবি তুলে থাকে এতে করে সুনির্দিষ্ট ভাবে ফুট ড্রপ নির্ণয় করা যায়।

ম্যাগনেটিক রিছোন্যান্স ইমেজিং: সাধারণত এমআরআই রেডিও ওয়াইফের মাধ্যমে শরীরের ভেতরের সফট টিস্যু গুলির অবস্থা নির্ণয় করে থাকে। যার ফলে সফট টিস্যু ধারা সৃষ্ট ফুট ড্রপ নির্বাচনে আরো আধুনিক ও সহজ হয়।

ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফি ও নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি টেস্ট: নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি ও ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফির মাধ্যমে মাংসপেশির এবং নার্ভের তড়িৎ কার্যক্ষমতা নির্ণয় করা হয়। সাধারণত এই দুইটি পরীক্ষার মাধ্যমে মাংসপেশি এবং নার্ভের কোন সমস্যা, সুনির্দিষ্ট অবস্থার নির্ণয় করা যায়।



ফুট ড্রপের চিকিৎসা ও পদ্ধতি সমাধানের উপায়:

সাধারণত ফুট ড্রপ জনিত সমস্যার ঠিক হতে ২/৩ রোগীর ফুট ড্রপ হওয়ার পর এক বছরেরও বেশি সময় লেগতে পারে। তাই ফুট ড্রপ জনিত সমস্যা চিকিৎসায় ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ নিউরোলজিস্ট এবং ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শে চিকিৎসা নিলে এই সমস্যা থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়।

ফুড ড্রপ জনিত সমস্যার সাথে যদি রোগী ব্যথা অনুভব করে তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরামর্শে পেইন কিলার নেওয়া যেতে পারে।

স্প্লিন্ট: ব্রেস বা স্প্লিন্ট হচ্ছে অর্থটিক্স ডিভাইস। বিভিন্ন ধরনের ব্রেস এবং স্প্রিন্ট জুতার সাথে ফিট করে পায়ের স্বাভাবিক অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই জাতীয় স্প্রিন্ট চলাফেরার সময় পায়ের ডরসিফ্লেক্সনের পরিমাণ বাড়াতে এবং পায়ের আঙ্গুল গুলির মাটিতে পড়ার পূর্বে পায়ের গোড়ালিকে আগে পড়তে সাহায্য করে এর ফলে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করা যায়। সাধারণত ফুট ড্রপের পরিমাণের উপর স্প্লিন্ট নির্বাচন করা হয়। স্প্রিন্ট স্টেটিক ও ডায়ানামিক দুই ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:- আঙ্কেল ফুড অর্থসিস (এ এফ ও), ফুট-আপ স্প্লিন্ট এবং ট্রপিক ইত্যাদি।

ফিজিওথেরাপি: ফুট ড্রপ এর ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকরী একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রাথমিক অবস্থায় একজন ফিজিওথেরাপিস্টের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জয়েন্টের রেঞ্জ অব মোশন ঠিক রাখা যাতে করে জয়েন্ট স্টিফনেস এবং কন্ট্রাকচার না হতে পারে। দুর্বল পেশী বিশেষ করে ডোরসি ফ্লেক্সর শ্রেণির মাংস পেশির শক্তি বৃদ্ধি করা এবং প্লান্টারফ্যাক্সর শ্রেণীর মাংসপেশীর নমনীয়তা বৃদ্ধি করা। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রিক্যাল মডালিটিস ব্যবহারের মাধ্যমে ফুট ড্রপ থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়।

সার্জারী বা অস্ত্রপাচার: সাধারণত স্প্লিন্ট এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় ফুড প্রজ্জনিত সমস্যার আশানের রূপ পরিবর্তন না হলে বিশেষত চিকিৎসকের পরামর্শে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে আরগো লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল প্রক্রিয়া।

ফুট ড্রপে আক্রান্ত রোগীর পরিচর্যায় যে সকল নিয়ম মেনে চলতে হবে:
- পা এবং পায়ের পাতা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- ফুট ড্রপের কারণে রোগীরা হাঁটাচলা করার সময় তীব্র ভারসাম্যহীনতায় থাকেন এতে করে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বহুল অংশে বৃদ্ধি পায়।তাই রোগীর চলাফেরা করার স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখতে হবে। রোগীর চলাফেরার রাস্তায় বৈদ্যুতিক ও টেলিফোনের তার অপসারণ করতে হবে।
- ঘরে পর্যাপ্ত আলো সুনিশ্চিত করতে হবে।
- সিঁড়িতে উঠানামা করার সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- পিচ্ছিল কোন স্থানে চলাফেরা পরিহার করতে হবে।



লেখক: সুশান্ত কুমার ঘোষ, ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, ডিআইইউ মেডিকেল সেন্টার