বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শিশু প্রতিবন্ধিতার কারন হচ্ছে সেরিব্রাল পালসি।
সেরিব্রাল পালসি হচ্ছে বাচ্চার জন্মের সময়, আগে অথবা জন্মের কিছু পরে ব্রেইন এর কোন আঘাত বা রক্ত চলাচলের ব্যঘাতের ফলে সৃষ্ট শারীরিক চলাচলের ও এর সমন্বয় এর সমস্যা।
সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ:একটা শিশু জন্মের সাথে সাথে সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ বুঝা যায় না। সাধারণত এটি বুঝতে পারা যায় শিশুটির ২-৩ বছর বয়সে।
লক্ষণ গুলো হচ্ছে-
১। শিশুর ধারাবাহিক উন্নতির বিলম্ব ঘটবে-যেমন: ৮মাস বয়সে বসা অথবা ১৮ মাস বয়সে দাঁড়াতে পারবে না।
২। শিশুটিকে গম্ভির অথবা নিস্তেজ দেখাবে।
৩। বাহু অথবা পা দূর্বল থাকবে।
৪। মাংসপেশির সংকোচন।
৫। হাত কাঁপা।
৬। সর্বদা এলোমেলোভাবে চলাফেরা।
৭। একনাগাড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাফেরা।
৮। এ সময়কালে অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে, যেমন- খাদ্য গলাধঃকরনে সমস্যা,কথা বলতে সমস্যা,কোন কিছু দেখতে সমস্যা এবং পড়ালেখার অক্ষমতা হবে।
এ লক্ষণ গুলো খুবই উল্লেখযোগ্য।
কখন মেডিক্যাল পরামর্শ নিতে হবে:যদি আপনি আপনার বাচ্চার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন কারনে চিন্তিত হন তাহলে আপনি স্বাস্থ্যককর্মী অথবা GP(GENERAL PARCTITION) এর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।
সেরেব্রাল পালসির সাথে মিলে যায় এরকম কয়েকটা কারন দেখেই হতাশ হবেন না। বরং একজন শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেরেব্রাল পালসি আছে কিনা তা নিশ্চিত করবেন। কিন্ত কয়েক মাস বা কয়েক বছর পর্জবেক্ষন না করলে নিশ্চিত হওয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। কারন এ রোগের কিছু লক্ষণ শিশুর কয়েক বছর বয়স হবার পর সুস্পষ্ট হয়।
পরীক্ষা – নিরীক্ষা :বিশেষজ্ঞ প্রথমে জিজ্ঞেস করবেন-
আপনার শিশুর স্বাস্থ্যগত ইতিহাস এবং উন্নতির সম্পর্কে। সেরেব্রাল পালসির বৈশিষ্ট্য মূলক লক্ষণ গুলো পরীক্ষা করবেন এবং গর্ভাবস্থায় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা এসব কিছু জানতে চাইবেন। তারপর তিনি শিশুর চলাফেরা এবং শেখার ক্ষমতা কেমন সেটাও দেখবেন।
ব্রেন স্ক্যান :
ব্রেন স্ক্যান সেরেব্রাল পালসি নিশ্চিত হতে সহায়তা করে। এ জন্য ব্রেনে কয়েকটা স্ক্যান করতে হতে পারে যেমন- আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান, MRI স্ক্যান, CT স্ক্যান। এছাড়াও EEG, EMG, Blood test করতে হতে পারে।
সেরেব্রাল পালসির কারন:সাধারনভাবে বাচ্চার শারীরিক বিকাশ আশানুরূপ না হলে সেরেব্রাল পালসি হতে পারে বলে ধারনা করা হয়। এর সাথে অনেক গুলো কারন জড়িত,
১।বাচ্চার ব্রেনে রক্তক্ষরণ অথবা ব্রেনে পর্যাপ্ত পরিমান রক্ত এবং অক্সিজেন না পাওয়া।
২।গর্ভাবস্থায় কোন সংক্রমকে আক্রান্ত হওয়া।
৩। জন্মের পূর্বেকার সমস্যা: preventricular leukomalacia (PVL) হলে। মা কোন সংক্রক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে যেমন রুবেলা, চিকেনপক্স, সাইটোমেগালো ভাইরাস, টক্সোপ্লাজমোসিস ইত্যাদি।
৪। জন্মের পরের সমস্যা: Asphyxiation (জন্মের সাথে সাথে দেরিতা কান্না অথবা অন্য কারনে মস্তিস্কে অক্সিজেন না পেলে) হলে, ব্রেনে সংক্রমক হলে (মেনিনজাইটিস), মাথা মারাত্বক আঘাত প্রাপ্ত হলে, রক্তে শ্যুগারের পরিমান কমে গেলে, স্ট্রোক হলে।
সেরেব্রাল পালসির জন্য প্রথাগত চিকিৎসা:সেরেব্রাল পালসির জন্য নির্দিষ্ট কোন ঔষুধ নেই। কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসা রুগীকে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে সহায়তা করে।
১। ফিজিওথেরাপিঃ শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে এবং চলাফেরার সমস্যা দূর করতে কৌশলগত কিছু ব্যায়াম শিখতে এ থেরাপি নিতে হয়।
২। অকুপেশনাল থেরাপিঃ প্রতিদিন আপনার সন্তান কাজের ভার কমানোর জন্য যে কান্নাকাটি করে, তা অন্য উপায়ে সহজ করার জন্য এ থেরাপির নিতে হয়।
৩। স্পীচ থেরাপিঃ কথা বলতে,যোগাযোগ করতে এবং খাদ্য গলাধঃকরনের জন্য এ থেরাপি নিতে হয়।
এছাড়া Medication, Treatment for feeding problems, Treatment for drooling এবং Surgery মতন চিকিৎসা নিতে হতে পারে।
সেরেব্রাল পালসির জন্য অত্যাধুনি চিকিৎসা:বর্তমান বিশ্বে কিছু অত্যধুনিক নিউরো-থেরাপি (উচ্চ প্রজুক্তির ব্রেইন ফিজিওথেরাপি) প্রচলিত হচ্ছে। এদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছেঃ
১। নিউরো মড্যুলেশনঃ এর আধ্যমে ব্রেইন এর যে সব অংশ কম কাজ করছে অথবা বেশি কাজ করছে, তাদের মাত্রা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেয়া যায়।
২। ট্রান্স ক্রেনিয়াল ফোটো-বায়ো-মড্যুলেশনঃ ফোটনিক স্টিমুলেশন এর মাধ্যমে ড্যেমেজড ব্রেইন এ ডিএনএ লেভেল এর রিপেয়ার সম্ভব।
৩। ট্রান্স ক্রেনিয়াল পালসড ম্যগ্নেটিক স্টিমুলেশনঃ এর মাধ্যমে আমাদের ব্রেইন ওয়েভ এর পরিবর্তন ঘটিয়ে ব্রেইন এর কার্জক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া যায় অনেক গুনে।
সেরেব্রাল পালসির রোগির জন্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন:সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুরা অন্য শিশুদের তুলনায় কিছু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। তাদের ভবিষৎ যাতে কষ্টের না হয় তার জন্য সমাজের সকল কে দৃষ্টি দিতে হবে।
সাধারণভাবে বললে:
১. জীবনের প্রতাশ্যা খুবই সহজ-সরল। কিন্ত তা যেন কষ্টে পরিণত হতে না পারে, তার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
২. সেরেব্রাল পালসি শিশুদের কর্মতৎপর এবং স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রে খুবই কম। তাদের স্বাধীনতায় যাতে হস্তক্ষেপ না হয় তার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
৩. অনেক শিশু মেইনস্ট্রিম স্কুলে যায় কিন্তু কারো কারো বিশেষ শিক্ষাকর প্রয়োজন। এবং তারা যাতে এ বিশেষায়ীত সেবা থেকে লাভবান হতে পারে সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
৪. বিভিন্ন কারনে সেরেব্রাল পালসি শিশুর জীবন দিন দিন প্রতিদ্বন্দ্বী মূলক হচ্ছে এবং পিতা মাতা এই ধরনের বাচ্চাদের নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যায় আছেন এবং তারা হতাশায় ভুগছেন। সুতরাং এ ধরনের বাচ্চাদের এবং তাদের পরিবারের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টি দিতে হবে।
লেখক: সুশান্ত কুমার ঘোষ, ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, ডিআইইউ মেডিকেল সেন্টার.