Author Topic: চিনির বিকল্প: ক্ষতিকর নয়তো?  (Read 1935 times)

0 Members and 1 Guest are viewing this topic.

Dr. Sushanta Kumar Ghose

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 363
  • Gender: Male
    • View Profile
চিনির বিকল্প: ক্ষতিকর নয়তো?

ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের প্রধান শর্তই হলো খাবার তালিকা থেকে চিনিকে বাদ দেয়া। তাই চিনির বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম মিষ্টিকারক উপাদান বাজারে পাওয়া যায় এবং এগুলো দিন দিন জনপ্রিয়ও হচ্ছে। ব্রাউন সুগার থেকে স্টেভিয়া বা জিরোক্যাল সবই এর অন্তর্গত। এসব দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ে অনেকের মনে দেখা যায় নানান প্রশ্ন। সেসবেরই উত্তর দেবার প্রয়াস আজকের পর্বে।

আমরা সচরাচর যে চিনি খাই তা টেবিল সুগার নামে যা পরিচিত। আমাদের দেশে এটি তৈরি করা হয় মূলত আখ থেকে। তাছাড়া ইউরোপীয় অঞ্চলে বিট রুট থেকে উৎপাদিত হয় বিট সুগার। আখ থেকে রস সংগ্রহ করে তাকে উচ্চ তাপে উত্তপ্ত করে চিনি সংগ্রহ করা হয়। এ চিনিতে চিনির পাশাপাশি কিছু উদ্বৃত্ত পদার্থ থাকে, যা মোলাসেস বা চিটাগুড় হিসেবে পরিচিত। বিশোধন প্রক্রিয়ায় এই মোলাসেস চিনি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে পাওয়া যায় বিশুদ্ধ চিনির ক্রিস্টাল, যা ব্যবহৃত হয় আমাদের নিত্যদিনের টেবিল সুগার হিসেবে। তবে, বিশোধন প্রক্রিয়ায় যদি মোলাসেস সম্পূর্ণ আলাদা করা না হয়, তাহলে পাওয়া যায় ‘র সুগার’ না অপরিশোধিত চিনি। এই র সুগার দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। আবার বিশুদ্ধ চিনিতে পুনরায় কিছু মোলাসেস যোগ করে তৈরি করা হয় বাদামি চিনি বা ব্রাউন সুগার। স্বাস্থ্যগত উপকারিতার বিষয় চিন্তা করে মানুষ ব্রাউন সুগারের দিকে ঝুঁকছে। ফলে পৃথিবীতে এই ব্রাউন সুগারের বাজার বেড়েই চলছে।

খাদ্যমান ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় সাধারণ চিনি, র সুগার ও ব্রাউন সুগারের খুব বেশি পার্থক্য নেই। সব চিনিই যেহেতু একই উৎস থেকে পাওয়া যায়, আখ বা বিট, তাই এগুলোর রাসায়নিক গঠন প্রায় একই। আখ থেকে পাওয়া চিনির মূল উপাদান সুক্রোজ। সুক্রোজ হলো গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজের সমন্বয়ে গঠিত একটা জটিল শর্করা বা ডাইস্যাকারাইড। বিশুদ্ধ টেবিল সুগারে প্রায় ১০০ ভাগই সুক্রোজ, র সুগারের প্রায় ৯৯ ভাগ। আর ব্রাউন সুগারে কিছুটা মোলাসেস যোগ করা হয় বলে এতে সুক্রোজের পরিমাণ প্রায় ৯৫ ভাগ। সবগুলোর মূল উপাদান একই বলে এদের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সেও খুব একটা পার্থক্য নেই, ৬৫ বা তার আশেপাশে থাকে। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বলতে বোঝায়, কোনো একটা খাবার কতো দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। যার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যতো বেশি, তার রক্তে গ্লুকোজ বাড়াবার ক্ষমতা ততো বেশি।

বর্তমানে চিনির বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম মিষ্টিকারক দ্রব্যের ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। খেজুর গুড় বা আখের গুড়ের ব্যবহার তো আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই আছে, নতুন যুক্ত হচ্ছে কোনোনাট সুগার, ফ্রুট সুগার, স্টিভিয়া ইত্যাদি। এছাড়া ক্যালরিবিহীন কৃত্রিম চিনি এসপারটেম, সুক্রালোজ ইত্যাদির ব্যবহারও বাড়ছে।

চিনির বিকল্প প্রাকৃতিক মিষ্টিকারকের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে গুড়ের কথা। আখের গুড় মূলত অপরিশোধিত চিনির একটা রূপ। তাই এর গুণাগুণও চিনির মতোই। এতে সুক্রোজের পরিমাণ প্রায় ৯২-৯৫ ভাগ, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৫। তবে এতে সুক্রোজের পাশাপাশি ভিটামিন বি৬ ও কিছু খনিজ লবণ থাকে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী। এদিক থেকে খেজুর গুড় তুলনামূলক ভালো, যদিও এটি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার অভাব রয়েছে। এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম, তাছাড়া এতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফেটের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ থাকে। তবে আজকাল সুপারশপগুলোতে ডেট সুগার নামে আরো এক রকম চিনি পাওয়া যায়। এটা মূলত খেজুর শুকিয়ে গুঁড়ো করে তৈরি করা হয়। এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স প্রকারভেদে ৫০ এর আশেপাশে থাকে। এতেও চিনির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অনেক পুষ্টি উপাদান থাকে। কোকোনাট সুগার চিনির আরো একটি প্রাকৃতিক বিকল্প। নারকেল গাছের রস থেকে এই চিনি তৈরি করা হয়। অনেকটা অপরিশোধিত থাকে বলে এরও গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশ কম, প্রকারভেদে ৩৫ থেকে ৫৫ এর মধ্যে। তাছাড়া ভিটামিন ও খনিজ লবণেরও ভালো উৎস হতে পারে কোকোনাট সুগার। বর্তমানে আরো একটা প্রাকৃতিক মিষ্টিকারক বাজারে জনপ্রিয়, সেটা হলো স্টেভিয়া। স্টেভিয়া গাছের নির্যাস থেকে এটি তৈরি করা হয়। এতে ক্যালরি ও শর্করার পরিমাণ খুবই কম, চিনির তুলনায় এটি প্রায় ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। তাই এটি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ তেমন বাড়ায় না। বিভিন্ন গবেষণায় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তেমন চোখে পড়েনি। বিভিন্ন দেশে ডায়েট পানীয় বা মিষ্টান্ন তৈরিতে এর ব্যবহার দেখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে এটি চিনির ভালো প্রাকৃতিক বিকল্প হতে পারে।

সেই আদিকাল থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক মিষ্টিকারক হিসেবে মধুর ব্যবহার করে আসছে। মধুর মূল উপাদানও সুক্রোজ। তাই এটিও চিনির মতোই কাজ করে। মধুর খাদ্য উপাদান ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে এর উপযোগিতা নিয়ে আমরা অন্য একটি পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তবে বলে রাখা ভালো, মধুর প্রকৃত উপকার এর মিষ্টি গুণের জন্যে নয়। বরং মধুতে থাকে প্রচুর এন্টি অক্সিডেন্ট ও খনিজ লবণ। এগুলো আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে।

আজকাল ডায়াবেটিস ও স্থূলতার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে জনপ্রিয় হচ্ছে বিভিন্ন কৃত্রিম মিষ্টিকারক দ্রব্য। জিরো ক্যালরি বা জিরো কার্বোহাইড্রেট বলে পরিচিতি পাওয়ায় এসবের প্রতি অনেকেই ঝুঁকছেন। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কৃত্রিম মিষ্টিকারক হলো সুক্রালোজ, যা ‘জিরোক্যাল’ নামে বাজারে পাওয়া যায়। সুক্রালোজ মূলত চিনির বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। প্রামাণ সাইজের ১ প্যাকেট সুক্রালোজে থাকে মাত্র ৩.৩ ক্যালরি, যা চিনির তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া এটি চিনির তুলনায় অনেক বেশি মিষ্টি স্বাদযুক্ত, তাই লাগেও পরিমাণে কম। সুক্রালোজ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে Splenda নামে পাওয়া যায়, যা FDA কর্তৃক অনুমোদিত। তবে এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব প্রশ্নাতীত নয়। কিছু গবেষণা বলছে, এর তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। ক্যান্সার বা ডায়াবেটিস বৃদ্ধিতে এর তেমন ভূমিকা নেই। আবার কিছু গবেষণায় দেখা যায়, ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে কৃত্রিম চিনির ভূমিকা আছে। আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন এরকম কৃত্রিম চিনি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা হলো, যাঁরা দীর্ঘদিন চিনিজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে অভ্যস্ত, যাদের রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাঁরা শুরুতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে এগুলো ব্যবহার করতে পারেন। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত না হলে এসব কৃত্রিম চিনি বাদ দেয়াই ভালো, কেননা, এগুলোর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব খুব সুখকর নয়।