ট্রিগার ফিঙ্গার:ঘুম থেকে উঠে মুঠো করা আঙুলগুলোকে খুলতে গিয়ে দেখলেন, আঙ্গুল আর খুলছে না! এই সমস্যাটির পেছনে আছে একটি যুক্তিযুক্ত শারীরিক সমস্যা। আর সেটির নাম হলো ট্রিগার ফিঙ্গার। ট্রিগার ফিঙ্গার স্টেনোসিং টেনোসাইনোভাইটিস নামেও পরিচিত। হাত মুঠো করার পর আঙুল আটকে যায়, আবার সোজা করতে গেলে ব্যথায় অনেক কষ্ট হয়। এ সমস্যায় অনেকেই ভুগেন, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস আছে। অনেক সময় আঙুল খুলতে গিয়ে অনেকটা পিস্তলের ট্রিগারের মতো শব্দ হওয়ায় এই সমস্যাটিকে ট্রিগার ফিঙ্গার বলা হয়। কখনো কখনো শব্দ ছাড়াও এই সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। কখনো হয়তো ব্যথা একটু কম বোধ হতে পারে।
কিভাবে ট্রিগার ফিঙ্গার হয়সাধারণত আমাদের আঙুল সোজা করতে ও বাঁকাতে দুইটি জিনিস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি হলো টেন্ডন, যার কাজ হলো পেশীকে হাড়ের সাথে আটকে রাখা। আর এই টেন্ডনকে হাড়ের ঠিকঠাক জায়গায় আটকে রাখে পুলি। এই টেন্ডনের চারপাশে থাকে সাইনোভিয়াম নামক এক রকমের টিস্যু। এটি আমাদের হাড়ের সংযোগস্থলের চারপাশ জুড়ে থাকে। টেন্ডন সহজেই যেন নড়তে পারে সেটা নিশ্চিত করে। সমস্যা শুরু হয় যখন প্রদাহজনিত কারণে এই টিস্যুর আকৃতি ছোট হয়ে যায়। যেটা পেশী, হাড় এবং পুর আঙুলের ওপরে প্রভাব ফেলে।
পুলি অঞ্চলে প্রদাহ হওয়া খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। আমাদের আঙুলের প্রতিটি সংযোগস্থলে এক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে আঙুলের জোড়ার মাঝে বাড়তি টিস্যুর উপস্থিতি দেখা দেয়। ফলে এই অবস্থায় যখন আপনি আঙুল সোজা করার বা বাঁকানোর চেষ্টা করবেন, টেন্ডন এক ধরনের বাঁধা পাবে। আঙুল খুলতে কষ্ট হবে। জোর করলে ব্যথাবোধ হতে পারে এবং একটা সময় আঙুল সোজা হতে পারে। তবে এই সময় একটা শব্দ শুনতে পাবেন আপনি। যেটা শুনতে অনেকটা পিস্তলের ট্রিগারের মতো হওয়ায় এই সমস্যাটির নাম দেওয়া হয়েছে ট্রিগার ফিঙ্গার।
ট্রিগার ফিঙ্গার এর উপসর্গ - যেকোনো আঙুল আক্রান্ত হতে পারে, তবে বুড়ো আঙুল, মধ্যমা ও রিং ফিঙ্গার বেশি আক্রান্ত হয়
- হাতের আঙ্গুল ভাজ করতে বা সোজা করতে কষ্ট হয়
- আঙুলের আক্রান্ত জায়গায় চাপ দিলে ব্যথা হয়
- হুট করেই হঠাৎ আঙুল সোজা হয়ে যাওয়া
- নির্দিষ্ট আঙুলে সারাক্ষণ এক ধরণের ব্যথাবোধ
- আঙুলে জড়তা, বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আঙ্গুল খুলতে না পারা
- আঙুল একবার বাঁকা করলে এরপর সোজা করতে না পারা কিন্তু আঙুল জোর করে
- সোজা করতে গেলে খানিকটা খট করে শব্দের সাথে ব্যথাবোধ করা
- চিকিত্সা না করা ট্রিগার ফিঙ্গার এর দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার মধ্যে স্থায়ী ফোলাভাব এবং সংকোচন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে
ট্রিগার ফিঙ্গার এর কারণএই রোগের নির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে কিছু রোগ ত্বরান্বিত করে, যেমনঃ ডায়াবেটিস, গাউট, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হাইপোথাইরয়েডিজম, অ্যামাইলয়েডোসিস, সারকোইডোসিস ইত্যাদি। সাধারণত এই সমস্যা বয়সের সাথে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যারা অতিরিক্ত হাতের কাজ করেন, যেমনঃ গৃহিনী, টাইপিস্ট, গার্মেন্টস শ্রমিক, ব্যাংকার, কৃষক, সঙ্গীতজ্ঞ ইত্যাদি। সম্প্রতি আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে যারা স্মার্টফোন দীর্ঘক্ষণ ধরে ব্যবহার করছেন তাদের মধ্যে আশংকাজনকভাবে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। আঙুলে নানারকম প্রদাহ, অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও ট্রিগার ফিঙ্গার সমস্যার কারণ হতে পারে। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে এই রোগ হয়ে থাকে।
ট্রিগার ফিঙ্গার এর ঝুকিতে কারা আছেনসাধারণত এই সমস্যা বয়সের সাথে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের বেশি হয়
পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি হয়
![](http://ট্রিগার ফিঙ্গার এর নির্ণয় পদ্ধতি:)
রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগের ইতিহাস জানা ও শারীরিক কিছু পরীক্ষাই যথেষ্ট। তবে রোগটি নিশ্চিতকরন ও অন্যান্য রোগ থেকে আলাদা করার জন্য কিছু পরীক্ষা প্রয়োজন। যেমনঃ কিছু রক্ত পরীক্ষা, হাতের এক্স-রে ও হাতের আলট্রাসাউণ্ড ইত্যাদি।
![](https://aspc.com.bd/wp-content/uploads/2022/11/%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%97.jpg)
![](http://ট্রিগার ফিঙ্গার এর চিকিৎসা কি)
ট্রিগার ফিঙ্গার সমস্যার চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে:
- প্রথমটি শুধুই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে করা হয়
- জীবনধাঁরার পরিবর্তন
- ফিজিওথেরাপিতে না হলে ইঞ্জেকশন ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে
- ওষুধ
- অর্থোসিস
- আর কোনটাতেই কাজ না হলে সার্জারির মাধ্যমে আঙুলের যে স্থানে টেন্ডন নড়তে সমস্যা হচ্ছে সেটা ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তবে, যে পর্যায়ের সমস্যাই হোক না কেন, ট্রিগার ফিঙ্গার সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। তাই, যতটা দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন এবং এই সমস্যার সমাধান করে ফেলুন।
ফিজিওথেরাপি:এখন মজার ব্যাপার হচ্ছে গতানুগতিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এই রোগের জন্য খুব একটা কার্যকর নয় কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকর হয় না মূলত রোগটি কেন হচ্ছে এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে। তাই প্রথমে আমরা রোগটি কেন হচ্ছে এর পরবর্তী কী কী সমস্যা হতে পারে এবং এই সমস্যাগুলো হতে আমরা কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রথমেই রোগীকে দিতে হবে।
একজন ফিজিওথেরাপিস্ট খুব সহজেই কিছু সুনির্দিষ্ট –
- থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ
- স্পেসিফিক থেরাপিউটিক স্ট্রেচিং,
- DTFM (ডিপ ট্রান্সভার্স ফ্রিকশন ম্যাসাজ)
- Cryotherapy (Ice),
- স্পি্লটিং/ট্যাপিং/এসেসটিভ ডিভাইস
- LASER
- UST
- প্যারাফিন ওয়াক্স চিকিৎসার মাধ্যমে খুব সহজেই সমস্যার সমাধান দিতে পারেন। এখানে মনে রাখতে হবে এই রোগের জন্য শুধু ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা গতানুগতিক চিকিৎসার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। সমস্যা খুব বেশি গুরুতর অবস্থায় পৌঁছালে-
- Corticosteroid Injection/Cortisone Injection দেওয়া যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে Corticosteroid Injection নেওয়ার পর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা না নেওয়া হলে পুনরায় সমস্যা ফিরে আসে। তবে কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং করতে হয়। তবে অপারেশনের পর স্বাভাবিক হাতের কর্মক্ষমতা ফিরে পেতে এবং হাতের সম্পূর্ন মুভমেন্ট ফিরে পেতে হলে অপারেশনের পরপরই অবশ্যই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে। সকল চিকিৎসা করার পরও ভালো হবে না বা এই সমস্যা আবারও ফিরে আসতে পারে যদি রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না রাখে এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এক্সারসাইজ না করে। সুতরাং ‘ট্রিগার ফিঙ্গার’ হতে পরিত্রাণ পেতে চাইলে দ্রুত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চিকিৎসা নিন। আশা করি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।
জীবনধাঁরার পরিবর্তনঃ- আক্রান্ত আঙ্গুলগুলোকে বিশ্রাম দেয়া
- দীর্ঘক্ষণ হাতের কাজ কম করা
-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা ইত্যাদি
ওষুধঃব্যথানাশক ওষুধ- এন, এস, এ, আই, ডি ও পায়ের তালুতে মলম ব্যবহার করা
অর্থোসিসঃআক্রান্ত আঙুলের বিশ্রাম ও হাতের আঙ্গুলের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য ফিঙ্গার স্প্লিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইনজেকশনঃব্যথা দীর্ঘমেয়াদি বা তীব্র হলে, আলট্রাসাউন্ড মেশিনের মাধ্যমে টেন্ডন/রগের চারপাশে ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে ও ইন্ট্রা-আর্টিকুলার কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
রোগের পরিণতি- সঠিক চিকিৎসা নিলে এ রোগ পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়
- উপরোক্ত চিকিৎসায় ভালো না হলে, অপারেশনের মাধ্যমে আঙুলের যে স্থানে টেন্ডন/রগ নড়তে সমস্যা হচ্ছে সেটা ছাড়িয়ে দিতে হয়
লেখক: সুশান্ত কুমার ঘোষ, ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, ডিআইইউ মেডিকেল সেন্টার