ছোট বড় সকলেরই একটা কমন হেলথ ইস্যু হল দাঁতে পোকা বা ডেন্টাল ক্যাভিটি। মায়েদের কমন কমপ্লেইন থাকে যে বাচ্চার দাঁত পোকা খেয়ে ফেলছে বা পোকা ধরে দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। শুধু শিশুদের নয়, এ সমস্যা যে কোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে। এর ফলে খুবই কষ্ট এবং যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। দীর্ঘদিন অবহেলার ফলে ক্যাভিটি বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে প্রয়োজন হতে থাকে ডেন্টাল ফিলিং, রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্টের। অনেক সময় শেষ উপায় হিসেবে দাঁতটি ফেলে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। এই কষ্ট থেকে বাঁচতে এবং একই সাথে সময় ও অর্থ বাঁচাতে প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
দাঁতে পোকা বা ডেন্টাল ক্যাভিটি কী?দাঁতে পোকা বলতে আমরা যা বুঝি সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে দাঁতে পোকা আসলে তা নয়। দাঁতে কালো কালো দাগ, ক্ষয় ধরা, স্পট হতে থাকা এগুলোকেই সাধারণ ভাষায় দাঁতের পোকা বলা হয়। দন্ত চিকিৎসার ভাষায় বা মেডিকেল টার্ম অনুযায়ী একে ডেন্টাল ক্যাভিটি বা ডেন্টাল ক্যারিজ বলে। ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই এই সমস্যায় কম বেশি ভুগতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এই সমস্যাকে সবাই খুব অবহেলা করে কারণ ক্যাভিটি হলে সাথে সাথেই কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বিশেষ করে শিশুরা বুঝতেই পারে না যে দাঁতে কোনো সমস্যা হচ্ছে। যত দিন যায়, ধীরে ধীরে সমস্যা বাড়তে থাকে। তখন চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল, কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়।
ক্যাভিটি কেন হয়?১) ডেন্টাল ক্যাভিটির জন্য মূলত দায়ী হল কিছু ব্যাকটেরিয়া, যেগুলো সাধারণত আমাদের সবার মুখেই থাকে। লম্বা সময় ধরে দাঁতে খাবার আটকে থাকলে এই সব ব্যাকটেরিয়া সেই খাবারে পচন ধরায় এবং দাঁতের গোড়ায় ক্ষত সৃষ্টি করে।
২) কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, রুটি, আলু এবং চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার দাঁতের ফাঁকে জমে থাকলে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বেশি হয়। চকলেট, চুইংগাম, ক্যান্ডি এসবও দায়ী ক্যাভিটি সৃষ্টির জন্য।
৩) দাঁত অপরিষ্কার থাকলে খাবার জমে প্ল্যাক বা ময়লার আস্তরণ তৈরি হয় এবং এই প্ল্যাকে এক ধরনের অ্যাসিড থাকে যা দাঁতের বাইরের শক্ত এনামেলকে ক্ষয় করে ফেলে। এনামেল ক্ষয় হয়ে ছোট ছোট গর্ত সৃষ্টি হয় এবং ক্যাভিটি বাড়তে থাকে।
৪) দাঁত ক্ষয় হতে হতে ব্যাকটেরিয়া এবং অ্যাসিড আরো গভীরে ঢুকতে থাকে যার ফলে দাঁতের স্নায়ু ও শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তীক্ষ্ণ ব্যথা হয়।
৫) লাইফস্টাইল, পার্সোনাল হাইজিন মেনে না চলা বা মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের জন্যেও দাঁতে ক্যাভিটি হয়।
৬) অনেকের অনেক রকম অসুখ থাকে যার কারণে মুখে লালা বা থুতুর পরিমাণ কমে যায়। এই থুতু মুখ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। লালার পরিমাণ কমে গেলে দাঁতে ক্যাভিটি হতে পারে।
লক্ষণক্যাভিটি হয়েছে এটা প্রথম দিকে বোঝা না গেলেও কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখা গেলে বুঝতে হবে দাঁতে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। যেমন- সারাক্ষণ দাঁতে ব্যথা থাকতে পারে, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ অসহ্য ব্যথা হতে পারে, অতিরিক্ত সেনসিভিটি এবং টক খাবার খেলে দাঁত শিরশির করা, মিষ্টি, গরম বা ঠান্ডা খাবার খেতে গেলে তীক্ষ্ণ ব্যথা ইত্যাদি। এছাড়া দাঁতে ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির ছিদ্র ও গর্ত খালি চোখে দেখা গেলে, দাঁতের ভেতর বা বাইরে বাদামি, কালচে বা হলুদাভ দাগ পড়লে, খাবার সময় প্রতি কামড়ে ব্যথা হওয়া- এগুলোর মধ্যে যে কোনো লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে আপনার দাঁতে ক্যারিজ হয়েছে।
কারণ
১) ক্যারিজের ঝুঁকি বেশি থাকে একদম ভেতরের দিকের দাঁতে। বিশেষ করে মাড়ির দাঁতে। এ সমস্ত দাঁতে খাঁজ ও গর্ত বেশি থাকে ফলে খাবার আটকে থাকে বেশি। সামনের দিকের দাঁত যত সহজে পরিষ্কার করা যায় পেছনের দাঁত তত সহজে পরিষ্কার হয় না। ফলে ক্যারিজের ঝুঁকি বাড়ে।
২) কিছু বিশেষ খাবার যেমন দুধ, আইসক্রিম, মধু, চিনি, শুকনো ফল, কেক, বিস্কুট, চিপস ইত্যাদি খাবার দাঁতে অনেক বেশি সময় ধরে আটকে থাকে। ফলে এরা ক্যারিজের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩) খুব ফ্রিকোয়েন্টলি কোক, সোডা বা মিষ্টি পানীয় পান করলে, স্ন্যাকস জাতীয় খাবার খেলে দাঁতের গোড়ায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য নতুন করে জ্বালানী পেয়ে যায়।
৪) ঘুমানোর সময় শিশুদের ফিডার বা দুধ খাওয়ালে তার অংশ বিশেষ অনেক সময় ধরে দাঁতে লেগে থাকে। এতে ক্ষয় বাড়তে থাকে।
৫) ঠিকমতো এবং নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করলে।
৬) অনেক সময় অতিরিক্ত অ্যাসিডিটির ফলে পাকস্থলির অ্যাসিডযুক্ত নির্যাস মুখ পর্যন্ত চলে আসে এবং দাঁতের ক্ষতি করে।
৭) মুখ বেশি শুকনো থাকলে বা মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণ লালা না থাকলে দাঁতে জমে থাকা খাবার ধুয়ে যেতে পারে না, যার ফলে ক্যারিজের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৮) শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে ক্যারিজের ঝুঁকি বেশি কারণ এই বয়সীদেরই দাঁতের যত্নে সবচেয়ে বেশি অবহেলা হয়।
পরামর্শ১) সকালে ও রাতে নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করতে হবে।
২) খাদ্য তালিকা থেকে অতিরিক্ত চিনি, স্টার্চ বা অ্যাসিড জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।
৩) দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকবে এমন খাবার কম খেলে ভালো।
৪) নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার ও পরীক্ষার জন্য ডেন্টিস্টের কাছে যেতে হবে।
৫) দাঁত ব্রাশ শেষে অ্যান্টিসেপটিক মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুলি করতে হবে।
৬) টুথপিকের বদলে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা ময়লা ডেন্টাল ফ্লস দিয়ে ক্লিন করা উচিত।
দাঁতে ক্যারিজ খুব পরিচিত একটি সমস্যা। দাঁতের নিয়মিত যত্ন না নিলে এই সমস্যাটি হবে এটা জেনেও আমরা অনেকেই সচেতন নই। দাঁতে ক্যারিজ হওয়ার পর যথাযথ চিকিৎসা না করালে পরবর্তীতে সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।
source:
https://www.shajgoj.com/